একগুচ্ছ কবিতা ।। মিনহাজ রাফি


 

 

.

উঠোন ভর্তি ভারাক্রান্ত জেসমিন ফুলের তর্জমা,

মগডাল বেয়ে নেমে আসা ফাঁকা রাস্তার ফোবিয়া,

একটি ছাগলের চোখে ম্যারাথন দৌড়ের চিরায়ত স্বপ্ন

                                              নিশ্চয়' মনে আছে।

 

                                     নিশ্চয়ই মনে আছে

আদিবাসী নদীর সম্ভাব্য সমস্ত উদাসীন হাওয়া

হলুদ দিঘির কোলে রপ্ত হওয়া যুবতি নারীর

সমবেত লোনলিনেস,

মফস্বলের স্মৃতি ব্যাগে মক্তবের শিশুদের

উড়ে যাওয়া হাওয়াই মিঠাই, ছেঁড়া ঘুড়ি

 

প্রেমিকার খোঁপায় চেয়ারম্যান বাড়ির বাগানবিলাস

চোখে সবুজ শৈল্পিক ঘাস,

সন্ধ্যের আকাশে মায়ের কমলা রঙের শাড়ির পাড়

দুবেলা খেতে না পারা কমরেড সাইফুর রূদ্রের

চোখে ঝুলতে দেখা ফেলানী লাশ

 

সমস্ত কিছু ছেড়েছুড়ে আসার পর

অজস্র দৃশ্যের ভিড়ে তবুও

                                                  মনে আছে

প্রাইমারি মাঠে নেমে আসা মাগরিবের আজান

বাইপাসের পাশে মরে যাওয়া বয়ষ্ক একটি বাগান

গ্রামীণ জানালার পাশে ফোটা মধ্যনিশি নির্ঘুম চাঁদ

বোনের বানানো মরিচ ভর্তার স্বাদ

                             অজস্র  মায়োপিক দৃশ্যের ভিড়ে

শেষ দেখে আসা জংশনে কিশোরী মেয়েদের

কানামাছি ভোঁ ভোঁ, বাবার পিঠের আঁকাবাঁকা পথ;

নিশ্চয়ই মনে আছে আমার, নিশ্চয়ই মনে আছে।

 

দুইহাজারচব্বিশ, ইহকাল


৩৮.

পৃথিবীর যতগুলো গানের কোলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি

   যতগুলো কবিতার মাঝে আমি হেঁটে এসেছি

                       সেসব গান, সেসব কবিতার মাঝে

তোমাকে' বারবার আমি খুঁজে পেয়েছি জ্যোতি।

 

               পৃথিবীতে যতগুলো উপসংহার আছে,

আছে যতগুলো শুভ্র সূচনা, ঝরা পাতার ইতিহাস

সমবেত আক্ষেপ                   নিকটতম অপেক্ষা

বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, প্রেম, শোক, ক্লান্তি

 তার সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে পেয়েছি তোমাকে, জ্যোতি।

 

পৃথিবীতে এখন অবধি যতগুলো গজল তেলাওয়াত হয়েছে

যতবার কোকিলের সারগাম নাজিল হয়েছে

ভাতের খালি প্লেটে বাজিয়েছে ক্ষুধার এসরা

সবুজের বুকে বৃষ্টিরা হয়েছে সেরেনাদ

ততবার তুমি হৃদয়ের মেঠো পথ ধরে অবতীর্ণ

             হয়েছ আমার মধ্যরাতের সবুরে।

 

তুমি কি টের পাও? মফস্ লে যতবার পাখিরা নীড় ছেড়েছে,

যখন পাহাড়ের সবুজ পাড় লাল শাড়ির দিগন্তে মিশেছে

টিনের চালে বসন্তরা এসেছে

যতবার জীবনানন্দ পাঠ হয়েছে শীতল টি স্টলে

ততবার তোমাকে খুঁজেছি, তুমি কি টের পাও জ্যোতি।

 

টের পাও? যে নির্জন রোডে

তুমি হেঁটে এসেছো শেষবার,

সে রোডের ধুলোবালি আমি

সবচেয়ে ভালোভাবে চিনে রেখেছি।

 

দুইহাজারচব্বিশ, ইহকাল


৩৭.

বিষণ্ণতার সারগামে রাত্রি নীল হচ্ছে।

বৃষ্টি এবং মেঘেদের কোলাবোরেশানে

ক্লান্ত হয়ে আসছে হৃদয়।

কবরস্থান থেকে ছুটে

আসছে বাবার পাঞ্জাবির গন্ধ।

মায়ের অভাবী ওড়না গলায়

পেচিয়ে দিয়েছে যন্ত্রণা।

কাঁটাযুক্ত লাগছে বিছানার শিথান

বিবিধ নস্টালজিক বন্ধুদের স্মৃতি

ঘুমোতে দিচ্ছে না।

থরথর করে কাঁপছে চোখ-ঠোঁট তথা জীবন।

আমাকে তোমার হৃদয়ের ভেতর

একটু টেনে না  চুলে বুলিয়ে দাও হাত

চোখে গুজে দাও বৃক্ষের ছায়া

ঠোঁটে দাও নরম মিহি আশ্রয়

আমি ঘুমিয়ে যাবো,

যেহেতু তুমি' আমার ঘুমপাড়ানির গান।

 

দুইহাজারচব্বিশ, ইহকাল


৩১.

শহরে বৃষ্টি নেমে আসলে

আব্বা কখনো' গোসল করতো না

বলতো, শীতল হাওয়ায় ঠান্ডা লেগে যাবে।

এরপর আম্মা রান্না ঘর থেকে চিল্লাতো

একটা প্রেশারকুকারের মতো

আর বলতো "ইশ খাটাশের খাটাশ"

এরপর শুরু হতো আব্বা আম্মার তুমুল ঝগড়া

আজ শহরে বৃষ্টি নেমেছে

পুরো শহর গোসল করলো

অদ্ভুতভাবে আজ আব্বাও গোসল করলো

কিন্তু আজ আব্বার গোসলের কথা শুনে

আম্মা খুশি হলো না.. উলটো

হাউমাউ করে কেঁদে অজ্ঞান হয়ে গেল।

আমি আম্মার চোখে মুখে বৃষ্টির পানি দিয়ে

উঠানোর চেষ্টা করছি আর বলছি,

"আম্মা উঠো আব্বাকে ঘরে দিয়ে এসে

আমার আরেকবার গোসল করা বাকি"

 

দুইহাজারচব্বিশ, ইহকাল


২২.

হাওয়া হয়ে যাব। হে প্রিয় নগর, হে মায়ের আঁচল,

                             হে প্রিয়তমা হাওয়া হয়ে যাব।

দর্পণের সম্মুখে ভিনদেশি দুঃখের নাচের ভঙ্গি,

বুকের পাহাড়ে ফিনাইলের ঘ্রাণ।

কপালে চড়ুইয়ের লন্ডভন্ড মোকাম,

এইসব আমাকে ক্লান্ত করে রেখেছে

                    আমি হাওয়া হয়ে যাব।

 

বরই গাছে বসে থাকা একাকি পাখির ঠোঁটের

                        এসরাজ থেকে ভেসে আসছে

বাবার জানাজার বিষণ্ণ লগন।

পিঠের আলমারিতে বন্ধুদের শত স্মৃতির চলচ্চিত্র।

নদীর শরীর লেপ্টে রেখেছি চোখে,

গোধূলির রোহিত লিপস্টিকের ঝলকানিতে

যে নিঃসঙ্গতা নিমজ্জিত হয় তার ডানায়

মাথা রেখে হাওয়া হয়ে যাব।

                                 

পুকুরের ঘোলা-ময়লার জলে যে মাছগুলো মরে ভেসে

আছে সে মাছগুলোর চোখের ভেতর

                   আমার জীবদ্দশার স্বপ্ন।

 

হে প্রিয় নগর, হে মায়ের আঁচল

হে প্রিয়তমা আমি হাওয়া হয়ে যাব।

বিমর্ষতার রেওয়াজ আমাকে আর আটকে রাখতে পারবেনা,

বিশ্বাসের নরম সারগাম আমাকে আটকে রাখতে পারবেনা,

আমি হাওয়া হয়ে যাব। হাওয়া...

 

দুইহাজারচব্বিশ, ইহকাল


কিসের দায় এড়িয়ে যাচ্ছোঅনাহত নিশ্বাসে

তুমি কিসের দায় এড়িয়ে যাচ্ছো,

হাওয়ার পথে ইল্যুশনের বাড়ছে,

মেঘ ডুবে যায় জলোচ্ছ্বাসের চোখে।

করিডোরের ফুলটব থেকে ছুটে আসে স্মৃতির দ্বৈরথ,

আমি দাঁড়িয়ে থাকিঅনড়, নির্বাক বৃক্ষের মতো।

তুমি বেগানা হয়ে উঠো কেন ক্রমশ?

মৌনতা, সেকি তোমার দেওয়া অমোঘ উপহার নয়?

পাখিদের মেলোডি রিডিয়ালে ডিপ্রেসড হয়ে আসে

পুরো ধূর্ত নগর, দ্বিধা জাগে প্রাত্যহিক হলুদ দুপুরে,

পশ্চিমের শূন্যতায় সান্ত্বনাকে মনে হয় শানিত ভাষা,

অনাহূত অনলে পুড়ে যায় আশ্রয়হীন হৃদয়,

রোমাঞ্চিত এসমস্ত নীরবতায় তুমি কিসের দায়

এড়িয়ে যাচ্ছোঅনাহত নিশ্বাসে।

 

ফেব্রুয়ারি/২৫


মরে গিয়েছে একটি নাস্তিক 

কোনো এক অভাবের রাতে আমি মায়ের ছটফটানি দেখে ইশ্বরকে প্রশ্ন করতে করতে করতে

বোকাচোদা রাষ্ট্রের বুকে খুন হয়ে যাবো গণতান্ত্রিক মন্ত্রীদের উন্নয়নের চাপে: এরপর আমি খুন হওয়ার

পর সরকারি মর্গে আমার লাশকে পোস্টমর্টেম করা হবে অস্ত্রসবার, এবং মায়ের শেষ শাড়ির আঁচল

হতে সুতো চুরি করে এনে সুইচ ব্যাংকে একাউন্ট খোলা প্রাক্তন প্রেমিকার প্রিয় ডোম আমার দেহে

সেলাই করে লিখবে-মরে গিয়েছে একটি নাস্তিক।

 

২৪ মার্চ/২১

 

জরাজীর্ণ শূন্যগ্রাম

যে সমবেত শোক ছুঁয়ে আমি শুয়ে আছি দৃশ্যত বেদনার হিমে

সে সমস্ত শোক হতে অনাবৃত সন্ধ্যা চলে যায় কতিপয় ছাতিম আয়ুর

ভ্রমণে। নিকটবর্তী ঝাউবনের গন্তব্যে জেনেছি হতাশাবোধে আমি

বিস্তৃত একটি জরাজীর্ণ শূন্যগ্রামযেখানে মৃত্তিকায় জন্মায় হাহুতাশ,

বাতাসের আশ্রয়ী স্রোতে দোলে ঘাসেদের জীবনী। জেনেছি

আমার একাকিত্বের মার্বেল নিয়ে ভেলকি করে ধূসর নিঃসঙ্গতা,

সম্মিলিত যে শোকাভিভূত দুঃখ ছুঁয়ে আমি বসে আছি অপসৃত রোদনের গ্রাফে,

সে সমুদয় দুঃখ আহত মাছের ফুলকায় কান পেতে শোনে বেঁচে থাকার

ফ্যান্টাসি। মনোহারিত্ব তরুতলে প্রার্থিত সরস মোহছায়া প্রবিষ্ট হয়ে যাচ্ছে

মৃত পাখিদের শেষকৃত্যে। শৈশবের ভাঙা সাইকেল হতে অপনীত হয়ে আসছে

পিপাসার্ত অভিলাষ, কদর্য ঘোর। ভরাশ্রু অনিদ্রার বিধিলিপি নিয়ে উপনীত হয়

অপয়া ললাট। রাত্রির যেসব নীলাভবর্ণ বেদনার প্রহারে অসহায়ত্বের চাদর ধরে

দাঁড়িয়ে আছে সময়সেসব বেদনাদের সন্নিহিতে আমি সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছি স্তিমিত

আকাশময় বায়ুর অতলে— সবিনয়ে।

 

১৪ ডিসেম্বর/২৪


বলে যাও

বলে যাও,

কাহারে ডেকেছিলা সেই শ্রাবণের ঘোরে?

যে রাতে পানশালায় 

শালিক গেয়েছিলো বিষাদগান!

তোমার কাঁধে ঝুলে থাকা উড়না

ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো বুনো উদাসীন বাতাস,

আর চুলের গন্ধে লেপ্টে ছিলো

আমার আঙুলের অগাধ আকুলতা, অনুনয় আর

অনাদৃত ভালোবাসার দীর্ঘশ্বাস।

 

১০ মার্চ/২৫

 


আমরা

.

কোনোদিন যদি ডুবে যাই গলার কাছে জমে থাকা

চিৎকারের অনুনয়ে, জেনে নিও, আমি ছিলাম

তোমারই আলতা রঙের অশ্রুর আতিথেয়তায়;

জেনে নিওফড়িংয়ের পাখার মতো আলগা

হয়ে গিয়েছিল সমস্ত অনুরাগ। রান্নাঘরের ধোঁয়া

আর শিউলি-ফোটা উঠোনের মাঝে হারিয়ে

ফেলেছিলাম লবণের স্বাদ। তবু ইচ্ছে করত,

হাতে রাখি হাত, কাঁধে সমবেত ক্লান্তির ছাপ।

বলতে পারি চলো, আজ শেষবারের মতো

বিশ্বাস করি, ছাতিম পাতার ফাঁক দিয়ে পড়ে

আসা বিকেলের টুকরোগুলোকে। কিন্তু তার আগে

পেন্ডুলামের মতো ছুটতে থাকা ভয় আমাকে টেনে

নিয়ে গেছে, সেই পাহাড়ের দিকে, সেই শূন্যতার

সরঞ্জামে, সেই পশ্চিমে ঝিমিয়ে যাওয়া হতাশায়

যেখানে একদিন, নিজেরাই ভুলে গিয়েছিলাম

নিজেদের নাম, বেনাম।

 

.

একদিন, কাচফোঁটার মতো চুপ করে গড়িয়ে পড়বে

সমস্ত উদাসীন সন্ধি, ম্লান হওয়া হাওয়া। চিকন সুরের

মতো ছিঁড়ে যাবে ধানখেতের ভিতর লুকানো নিরবতা। করুণা।

অনাগ্রহ প্রহর। আমরা দাঁড়িয়ে থাকবো

ছাইয়ে ঢাকা নদীর চওড়া পোতাশ্রয়ে, পায়ের কাছে

গড়িয়ে পড়বে কিছু অবিরত, অবিশ্বাসী আকাশ,

রঙহীন মুহুর্ত, শূণ্য বাজার ব্যাগের জ্বালাপোড়ন।

নাবালক ঘাসেদের ডগায় চুপচাপ পুড়ে যাবে ফেলে

আসা আনমনা বিকেলের নিনাদ, অপেক্ষাকৃত ভ্রম।

নুন মাখা বাতাসের ভেতর খুঁজবো ভুলে যাওয়া

শাসিত প্রেম আর্জিত ঘ্রাণ। তখন ইচ্ছেগুলো থাকবে

টিনের কৌটোর ভেতর। আর আমি টের পাবো

আমাদের ছোট ছোট পায়ে ঢাকা স্বপ্ন, জমে গেছে

কোনো ভগ্ন সুদূরের হিমঘরে। টানতে-টানতে ছিঁড়ে

যাচ্ছে তৃষ্ণা, পাশবালিশে রেশমি উপশম। আর সেই

অজানা ছিন্ন সকালের দিকে চেয়ে থাকবোঠিক

যেমন কেউ হারিয়ে ফেলা নাম খোঁজে ভস্মে গড়া

এক বাতাসের দেয়ালে, দৃশ্যত হাহুতাশে।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ