কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের দশটি কবিতা








অশ্রুর দিকে

অশ্রুর দিকে যাচ্ছি। গাছপালা, পথের কাঁটাঝোপ, টলটলে ঝিল, ধূলিবালি আর কাদা, সমূহ চলাচল, উৎসুক আলো, পোড়া রোদ, কা কা কা কাক, দিঘল গ্রীবা কালো রাজহাঁস, বেতফল সকলি সকল আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। কেন করছে? 

আসলে কেউই অপেক্ষা করছে না। আমি এইসব ভাবছি ভয়ে, ভাবছি কতকিছু অপেক্ষা করছে আমার জন্যে! এই ভয় ঘিরে আসে হাড়ের ভেতর থেকে। হাড়ের ভেতর থাকে মানুষের চেতনা, বেদনা হয়ে থাকে। 

অশ্রুর দিকে যাচ্ছি। আর অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। অশ্রুর চরাচর সমস্ত হয়ে আছে মরুভূমি, মরুভূমি। এই কথা আমি জানি, যেমন জানো তুমি। 

২০-০৪-২৫


কালো একটা বাঘ


কালো একটা বাঘ চক্রাকারে সরে যায় আকাশ থেকে 

আমি ভাবি ভোর হয়

ঘুরে ঘুরে আবারও আসে বাঘ মুহূর্তের পর 

সন্ধ্যা আর রাতের ভেদ নেই যেন 


ওষ্ঠাধারে লেগে আছে মাছির পায়ের ছাপ 

মাছিও একদা মাছ ছিল 

তার গায়ে নুনের অযুত দাগ

তার জিভে শঙ্খের শ্লেষ্মা 

শ্লেষ্মায় ভর করে আছে সমুদ্র ও পাতালের নকশা 


ফুলে ফুলে বিষ 

বহুদূর মাছ থেকে এসে মাছি তাই হতে পারে না মৌমাছি 

কেবল বাসনায় পুড়ে মরে আটাশহাজার চোখ নিয়ে


কালো একটা বাঘ

ধূর্ত আর হিংস্র ব্যাঘ্র হয়ে নিকাশ করে বুক 

নিকাশ করে বুকের মাঝখানটায় জমা একফোঁটা মেঘ 

তখন পৃথিবীর মেঘমল্লার এক লহমায় হয়ে যায় বাষ্প।


১০-০৩-২৫



মেঘে যাই


মেঘে যাই

অপৃথিবীর মেঘে 

মেঘে মেঘে মিশে নামানো যায় ভার 

আকাশ ঘষে বানানো যায় স্মৃতির আকার 


মেঘে যাই 

পৃথিবীর ক্লেদ ছেড়ে 

মেঘের আইসক্রিমে লেগে আছে চেনা স্বাদ 

একটিমাত্র রাতে গলে পড়েছিল অর্ধেক চাঁদ


মেঘে যাই 

শাদা শাদা মেঘের কাগজে 

প্রুশিয়ান নীলে এঁকে দেবো জলরং ছবি 

এঁকে দেবো তিনতালে নিহত সন্ধ্যার পূরবী 


মেঘে যাই

নিয়ে যাই জিরাফের ঠার

মেঘের নরম দেহ যেন বা বেঁকে আছে বন 

শ্বাসভরে টেনে তাকে দেবো চির আলিঙ্গন। 


১৯-০২-২৫



অভিশাপ


একটা হাঁস নিয়ে চলে যাচ্ছি, রেখে যাচ্ছি ছড়িয়ে বিরান ঘাসবন। তোমাকে যে বিরহ দিয়েছি, তা নিয়ে জেনো, একবারই কবি হওয়া যায়। তারপরে শূন্যতা মহাকাশ।


একটা হাঁস নিয়ে চলে যাচ্ছি, পরমহাঁস।


১৩-০২-২৫



আইসক্রিম


শীতকাল তবু, আইসক্রিম গলে গেছে হাতে। ময়ূরপাখি একা, নেচে নেচে খসিয়ে পালক বোকা হয়ে আছে। 


ডেকে যায় ডর, বনের ভেতর। হালিকের রাতগুলি সেগুন পাতায় ঢাকা, জেনে যায় ঝিঁঝিঁ, ডেকে ডেকে কেঁপে যায় পাতার আড়াল। আড়ালের আড়ে মরে থাকে প্রাণ, পাতা আর পাতাবাহারের। 


দেয়ালের জানালারা বাঁকা হয়ে গেলে, চোখের তারায় জ্বলে বরফের স্মৃতি। 


আইসক্রিম! আইসক্রিম! ময়ূর নাচন, হালিকের রাত আসে ফাঁকি দিয়ে বন, তবু শাঁখার শরীরে কারো হাতের রক্ত লাগে, ভোরেরও আগে। 


এইসব গল্প সন্ধ্যা আর ভোরের মাঝখানে চক্রমিত হয় কোন সে মন্ত্রে, জানতে পারে না তারা বা আকাশের তারা। 


শীতের রাতে আইক্রিম গলে যায় কারো হাতে, যদি সে ময়ূর হয়, কারো অভিসম্পাতে।


২৩-০৯-২২



ভুলে গেছি


কী এক নদীর নাম, কার কাছে বলেছিলাম! মনে নেই। কুকুর যেমন ঘ্রাণ শুঁকে চিনে নিতে পারে অপরিচিতেরও পরিচয়, তেমন করে কার নাভীমূলে ডুবে গিয়েছিলাম! ভুলে গেছি, তবু নিহত গানের তলে এখনও তার ছড়ানো সর্বনাম। 


চাঁদনেভা রাত্রি মেঘ করে আসে, শুধু মেঘ করে আসে। বিরান ছাদের মাঠে হাওয়াদল এসে ভেঙে পড়ে, আর ভেঙে পড়ে। পাগলের চুলে ধূলিকালি এসে লিখে রাখে কার নাম! ভুলে গেছি।


০৮-০৯-২০



পাগল ও বাঘ


বিলম্বিত লয় গান এসে বসে থাকে দেয়ালের গায়ে। নতমুখে মাপে ঝিরির শিশু শিশু স্রোত। কারও বুক ফুঁড়ে উঁকি দেয় সূর্যের স্মৃতি। তার নিচে একটি তারা নিঝুম এই গানের গন্ধে ডুবে থাকে। আরও নাম আছে শঙ্খের পাশে চিরদিন। ইগলের চোখে তাকিয়ে একা একটি পাগল উড়ে চলে আরও আকাশ চিরে।


একটা সিংহ আকাশের ডানা কামড়ে খেয়ে যায়, তার সিংহিনীর কাছে। ডানা ছিল বাতাসে বানানো সবুজ ছায়া। এই দেখে একটা মহিষ হেসে হেসে কাদা, কাদাজলে স্নান করে গা থেকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলে আনন্দের সকল দাগ। দাগের আগে তার শরীরে ছিল কবেকার ক্ষয়ে যাওয়া একা একটি বাঘ। 


০৬-০২-২৫



চিঠি 


তোমার কাছে চিঠি লিখছি,
এর মানে নদীতে লিখে রাখছি জল।

২৯-০১-২৫



অপেক্ষা 

তুমি বনপাহাড়ে জন্ম চেয়েছিলে। গাছে গাছে পরস্পর দূরত্ব বাড়ে না বলে তুমি হতে চেয়েছিলে গাছ। আরেকটি গাছের পাশে দাঁড়িয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দেবার বাসনা এত বেশি কিছু নয়, কেবল ডালপালায় পাতায় পাতায় ছুঁয়ে আনন্দ-হাহাকারের ছোট্ট জীবন, মিলন আর বিচ্ছেদের মধ্যখানে পাশাপাশি দাঁড়ানো গাছের জীবন।  

কিন্তু নির্দয় ঈশ্বর তোমাকে বানিয়ে দিল মানুষ। এখন অবিশ্বাসী হয়েও আরেক জন্মের অপেক্ষা ছাড়া তোমার আর করবার কিছু নেই।

২৫-০১-২৫


রাত্রি 

রাত বাড়লে বুঝতে পারি রাত্রি এসেছে, 
আর রাত্রির গন্ধ পাই।

২৫-০১-২৫


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ