মাটির মর্মে অদম্য আদিবাসী || মিনহাজ রাফি


এই বন যে আমার মাগো আমি তারই ছেলে,

অবাধ চলন বলন আমার তারই কোলে,

এই বন যতদূর ঠিক তত দূর আমার বাড়ি,

এই মাটিতে পোতা আছে আমার নাড়ি।

কথা ও সুর: মাদল

আজ বিশ্ব আদিবাসী দিবস। আসুন কিছু কথা বলি।

বাংলাদেশের মাটিতে বয়ে যাওয়া নদী, পাহাড়ের শ্যামলিমা আর বনভূমির গভীরে লুকিয়ে আছে বহু শতাব্দীর প্রাচীন মানুষের গল্প—যাদের আমরা আদিবাসী নামে চিনি। তারা এই ভূখণ্ডের প্রথম বাসিন্দা, এই মাটির গন্ধ, এই বনের শ্বাস, এই নদীর স্রোত যেন তাদের আত্মার অংশ। চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতাল, হাজং, খাসিয়া, মণিপুরী—প্রতিটি জনগোষ্ঠীই তাদের নিজস্ব ভাষা, গান, নৃত্য, উৎসব আর বিশ্বাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে আছে অবিশ্বাস্য বেদনা—অধিকারহীনতা, দমন-পীড়ন আর উচ্ছেদের নির্মম ইতিহাস।

ভূমি দখল এই ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো ও গভীর ক্ষত। পূর্বপুরুষদের বসতভিটা ও ফসলের মাঠ, যে পাহাড়ের ঢালে বা বনের ছায়ায় তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাটিয়েছে, সেই জায়গাগুলো বারবার কেড়ে নেওয়া হয়েছে নানা অজুহাতে। উন্নয়ন প্রকল্প, ইকো পার্ক, বন সংরক্ষণ কিংবা সেনা শিবির স্থাপনের নামে অনেক পরিবার রাতারাতি হারিয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি মধুপুর গড়ের গারো জনগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এমনই এক দখল-প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ছিল। সেদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তরুণ নেতা পীরেন স্লান। তার রক্ত লেগে থাকে মধুপুরের লাল মাটিতে, তার মৃত্যুর ধ্বনি এখনো প্রতিধ্বনিত হয় গারোদের গানে, তাদের শোকসভায়, তাদের প্রতিবাদের স্লোগানে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এই সংগ্রাম আরও রক্তাক্ত। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী দশকের পর দশক ধরে সহিংসতা, উচ্ছেদ, অপহরণ ও হত্যার শিকার। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন রাতের অন্ধকারে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দিন, খাগড়াছড়ির নিজ বাড়ি থেকে অপহৃত হন পাহাড়ি নারী ফেডারেশনের সংগঠক কল্পনা চাকমা। তাকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা নিয়ে যায়, এবং তারপর থেকে তিনি আর কোনোদিন ফিরে আসেননি। তার নিখোঁজ হওয়া শুধু একটি রহস্য নয়, বরং একটি ক্ষত—যা আজও ন্যায়বিচারের অপেক্ষায়।

২০১৬ সালের মার্চে রাঙামাটির নানিয়ারচরে পাহাড়ি পরিবারগুলোর ঘরে আগুন লাগিয়ে উচ্ছেদ করা হয় বহু মানুষকে, যার পেছনে ছিল জমি দখলের তীব্র লোভ। ২০১৮ সালে খাগড়াছড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন অন্তত ৭ জন পাহাড়ি অধিকারকর্মী। এমনকি শান্তিচুক্তির দুই দশক পরও পাহাড়ে সহিংসতা থামেনি, বরং ভিন্ন ভিন্ন রূপে চলছে।

সমতলের আদিবাসীরাও বঞ্চনা থেকে মুক্ত নয়। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের শতবর্ষের বসতি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ধানখেতের পাশে থাকা সেই কাঁচা ঘরগুলো মুহূর্তে ধোঁয়ায় মিশে যায়, সঙ্গে হারিয়ে যায় শত শত পরিবারে জীবিকা ও আশ্রয়। এই ঘটনার ভয়াবহ চিত্র দেশ-বিদেশে আলোচিত হলেও ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই এখনো তাদের জমি ফেরত পাননি। নেত্রকোনার কলমাকান্দায় হাজং জনগোষ্ঠীর জমি দখল ও হামলার ঘটনা বহুবার ঘটেছে, কিন্তু বিচার খুব কমই এসেছে।

এগুলো শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা নয়—এগুলো একটি ধারাবাহিক বাস্তবতা। একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা হারানোর ভয়, সংস্কৃতি বিলুপ্তির শঙ্কা, নারী-পুরুষ উভয়ের ওপর সহিংসতা, আর রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে প্রান্তিক অবস্থান—সব মিলিয়ে আদিবাসীদের জীবন প্রতিদিনই একটি সংগ্রাম। তাদের গান এখন আর শুধু উৎসবের জন্য গাওয়া হয় না, বরং বেদনার দলিল হয়ে ওঠে। তাদের নৃত্য এখন আর শুধু আনন্দের প্রকাশ নয়, বরং বেঁচে থাকার দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক।

বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলের এই মানুষেরা একদিন যদি তাদের অধিকার ফিরে পায়, যদি তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিরাপদ হয়, যদি উন্নয়নের পথে তাদেরও সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়—তবেই এই ভূখণ্ড সত্যিকার অর্থে সমৃদ্ধ হবে। নইলে একদিন হয়তো আমরা শুধু গল্প শোনাবো সেই মানুষগুলোর, যারা একসময় এই মাটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বেঁচেছিল, অথচ যাদের ইতিহাস আমরা রক্ষা করতে পারিনি।

বাংলাদেশের প্রতিটি আদিবাসীকে বিপ্লবী সালাম। সংগ্রাম চলতে থাকুক কমরেডস!


তারা উন্নয়নের নামে দেখ দেয়াল তোলে

তারকাটাতে ভিন্ন করে মা আর ছেলে

এত দিনের জীবনবোধে হানলো কারা

মায়ের ছেলে হোশ যদি রে রুখে দাঁড়া

কথা ও সুর : মাদল


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ