বাংলাদেশ একটি বহু-সংস্কৃতির দেশ, যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করছে। এখানে একেকটি ধর্মের ভিন্ন সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব এবং বিশ্বাস একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিপূর্ণতা গড়ে তুলেছে। এই সহাবস্থানের মূল ভিত্তি হলো পারস্পরিক সম্মান, অন্যের বিশ্বাস ও পবিত্র স্থানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব।
তবে সহাবস্থান মানে কখনোই একে অপরের ধর্মীয় স্থান দখল করা বা পরিবর্তন করার চেষ্টা নয়। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মতো সুপ্রতিষ্ঠিত তীর্থস্থান, যেখানে বহু শতাব্দী ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভক্তরা পূজা ও আরাধনা করছে, সেখানে অন্য ধর্মের উপাসনালয় নির্মাণের চেষ্টা কেবল স্থাপত্যগত নয়; এটি সেই ধর্মীয় অনুভূতি এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সরাসরি লঙ্ঘনের সমতুল্য। এমন প্রয়াস সমাজে অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে, যা বহু ক্ষেত্রে সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। ইতিহাসে দেখা গেছে, ধর্মীয় স্থানের অবমাননা বা দখলের প্রচেষ্টা প্রায়ই পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক বিভাজন এবং শান্তি বিঘ্নিত করার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চন্দ্রনাথ পাহাড় শুধু একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান নয়, এটি ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি জীবন্ত প্রতীক। এই পাহাড়ের শৃঙ্গের মধ্যে সমাহিত আছে বহু শতাব্দী ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের আস্থা, ভক্তি এবং আধ্যাত্মিক অনুভূতি। চন্দ্রনাথ পাহাড় সীতাকুন্ডে হিন্দুদের জন্য একটি অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান। এটি শুধু একটি পাহাড় নয়, এটি একটি শক্তিপীঠ যেখানে ভগবান শিব জাগ্রত ছিলেন বলেও বিশ্বাস করা হয়। পুরো পাহাড়জুড়ে বিভিন্ন মন্দির আছে, আর প্রতিটির নিজস্ব তাৎপর্য রয়েছে। যারা হিন্দু সম্প্রদায় আছে তারা এখানে ভক্তিভরে তীর্থযাত্রা করে। অন্য ধর্মের কেউ এটিকে কেবল দর্শনীয় স্থান বা পর্যটন স্পট মনে করতে পারেন, এটা স্বাভাবিক। তবে এর মানে এই স্থানের মাহাত্ম্য কমে যায় না।
যে কেউ চাইলে এখানে আসতে পারেন, কিন্তু তীর্থস্থানের দায়িত্ব ও মাহাত্ম্য বোঝা শুধু ভক্তদের। ঠিক একইভাবে, যদি আপনার পবিত্র স্থানে কেউ এসে তার ধর্মীয় কাজ করতে চায়, সেটা স্বাভাবিকভাবেই আপনাকে অস্বস্তি দেবে। চন্দ্রনাথ মন্দির সেখানে স্থাপিত হওয়ার পর থেকে এটি কেবল একটি পূজাস্থল নয়, বরং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের হৃদয়ে, বিশ্বাসে ও জীবনের ধারাবাহিকতায় গেঁথে থাকা এক আত্মিক তীর্থস্থল। প্রতিবছর হাজারো ভক্তের পদচারণা, পূজা ও আরাধনার ধ্বনিতে এই পাহাড় যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, প্রতিটি শিলা ও গিরিখণ্ডকে পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া দেয়।
এই অবস্থায় সেখানে মসজিদ নির্মাণের দাবি তোলা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি এক ধরনের অবমাননা। পাহাড়ের প্রতিটি স্তর, মন্দিরের প্রতিটি শিলা, মানুষের ভক্তি ও স্মৃতির প্রতিটি কোণ যেন জানায় এখানে শুধু স্থাপত্য নয়, বরং বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অভিব্যক্তি রয়েছে। এমন পবিত্র স্থানে নতুন স্থাপনা, বিশেষ করে ভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় তৈরি করা, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক সমবেদনার ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করে।
সামাজিক দিক থেকেও এটি বিপজ্জনক। একদিকে কিছুসংখ্যক ধর্ম ব্যবসায়ীদের দাবির মাধ্যমে ভাবানো হতে পারে “আমাদের অধিকার আছে”—অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের হৃদয় ও বিশ্বাসকে আঘাত পৌঁছায়। পাহাড়ের প্রাচীন শিখরগুলো যেন নিস্তব্ধ হয়ে চিৎকার করে “আমাদের ইতিহাস, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের সংস্কৃতি রক্ষা করো।” এমন সংবেদনশীল জায়গায় মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ সামাজিক সম্প্রীতিকে ব্যাহত করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে, সহাবস্থানের সূক্ষ্ম সুতাগুলো কেটে দেয়।
অন্যদিকে ইসলাম ধর্মের কোথাও জবরদখল বা কারও পবিত্র ভূমি দখলের শিক্ষা দেয় না।
কোরআন শরীফে আল্লাহ তাআলা বলেছেন—
“তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আর আমার জন্য আমার ধর্ম।” (সূরা আল-কাফিরুন, আয়াত: ৬)
এই আয়াত স্পষ্ট করে যে অন্য ধর্মের মানুষদের নিজ নিজ উপাসনালয়, প্রথা ও বিশ্বাসকে সম্মান জানাতে হবে। চন্দ্রনাথ পাহাড় বহু শতাব্দী ধরে হিন্দুদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। সেখানে জোর করে মসজিদ বানানোর প্রচেষ্টা এই আয়াতের চেতনার পরিপন্থী।
আবার কোরআনের আরেক স্থানে বলা হয়েছে—
“আল্লাহ তোমাদের তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে ও ন্যায়নিষ্ঠা প্রদর্শন করতে নিষেধ করেন না, যারা তোমাদের ধর্মের কারণে যুদ্ধ করেনি বা তোমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেনি।” (সূরা আল-মুমতাহিনা, আয়াত: ৮)
অর্থাৎ, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও ন্যায়বিচারই ইসলামের নির্দেশ। তাদের উপাসনালয়কে দখল বা আঘাত করা বরং নিষিদ্ধ।
হাদিসেও একই শিক্ষা পাওয়া যায়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন, যেখানে তাদের উপাসনালয়কে সুরক্ষিত রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। তিনি কখনোই অন্য ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র স্থানে মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেননি। বরং তিনি বলেছেন:
“যে ব্যক্তি মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের ক্ষতি করে, আমি কিয়ামতের দিনে তার বিপক্ষে সাক্ষ্য দেব।” (আবু দাউদ, হাদিস ৩০৫২)
এই হাদিসের আলোকে স্পষ্ট, চন্দ্রনাথ পাহাড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থানে মসজিদ করার প্রচেষ্টা তাদের ধর্মীয় অধিকারের লঙ্ঘন হবে, যা ইসলামের শিক্ষার বিরোধী।
মসজিদ নির্মাণ অবশ্যই ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কিন্তু মসজিদ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হলো মুসলিম সমাজের প্রয়োজন মেটানো। যেখানে মুসলমানদের বসবাস নেই, কিংবা যেখানে মসজিদ করার কারণে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, সেখানে মসজিদ নির্মাণের কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাছাড়া ইসলামে বলা হয়েছে,
“পৃথিবীই আমার জন্য মসজিদ করে দেওয়া হয়েছে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস ৩৩৫)
অর্থাৎ, মুসলমান যেকোনো পরিচ্ছন্ন স্থানে নামাজ আদায় করতে পারে। তাই চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মতো বিতর্কিত ও সংবেদনশীল স্থানে মসজিদ করার কোনো প্রয়োজন নেই।
"For you is your religion, and for me is my religion." (Surah Al-Kafirun, 6)
"Allah does not forbid you from those who do not fight you because of religion or drive you out of your homes from being righteous and just to them." (Surah Al-Mumtahina, 8)
"Whoever harms non-Muslims living under a Muslim state, I will bear witness against him on the Day of Judgment." (Abu Dawood, Hadith 3052)
"The whole earth has been made a mosque for me." (Sahih Bukhari, Hadith 335)
0 মন্তব্যসমূহ