অপর নাকি অমর: শহীদ নূর মোস্তফা প্রসঙ্গে ।। সাজিদ সামী চৌধুরী

 



বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন অনেক আখ্যান অলিখিত থেকে যায়, যা প্রাতিষ্ঠানিক ডিসকোর্সের অংশ হয় না, সংবাদ শিরোনামের পরিসরে আসে না, এমনকি রাষ্ট্রীয় নথিপত্রেও যার স্বীকৃতি মেলে না। অথচ এ ধরনের গল্পগুলোই নিহিত থাকে এক একটি রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের মূলে। এমনই এক করুণ অথচ অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগের উপাখ্যান হলো শহীদ নূর মোস্তফার জীবন। 

শহীদ নূর মোস্তফা, কক্সবাজারের দারুস সালাম দাখিল মাদ্রাসার একজন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বয়স মাত্র ষোলো। এদেশের মাটিতেই তার জন্ম, এই শহরেই তার বেড়ে ওঠা। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখা তার কাছে নিছকই একটি মানচিত্র ছিল না, বরং ছিল তার শৈশবের আঙিনা, শিক্ষাপ্রাঙ্গণের অলিন্দ, গণমিছিলের প্রাঙ্গণ এবং প্রতিবাদের স্লোগানে মুখর রাজপথ। নূরের কাছে ‘দেশ’ ছিল স্বপ্ন, সংগ্রাম আর সম্ভাবনার এক সমার্থক প্রতিশব্দ। এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব, যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে রুখে দাঁড়ানো যায়। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়কালে যখন সারাদেশে মুক্তিকামী সাধারণ জনগণের সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দেশ ও দশের প্রতি আরোপিত বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে, তখন নূরও নিষ্ক্রিয় থাকেনি। 

এক বিকেলে নূর যখন হাতে মোবাইল নিয়ে নিস্তব্ধ বসেছিল, তখন স্ক্রিনে ভেসে ওঠে তার এক সহযোদ্ধা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী এবং সমগ্র অভ্যুত্থানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার শহীদ আবু সাঈদের রক্তাক্ত ভিডিও। বুলেটের আঘাতে সে রাজপথে লুটিয়ে পড়েছে। তার রক্তে রঞ্জিত চারপাশ, যেন এক নিষ্ঠুর প্রতিবাদচিত্র, যা লাল রঙে আঁকা। এই দৃশ্য নূরের মধ্যে এক গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বাবার দিকে তাকিয়ে এক নিশ্বাসে সে বলে ওঠে, “আবু সাঈদ যদি জীবন দিতে পারে, আমি পারব না কেন?” তার কণ্ঠে ছিল বিদ্রোহের সুর, যা দেশপ্রেমের গভীরতায় সিক্ত।

তার বাবা, শফিউল আলম, সে মুহূর্তে কিছু বলতে পারেননি। তার চোখে ছিল আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার ছাপ। তিনি উপলব্ধি করতে পারছিলেন, তার ছেলে যা বলছে, তা আবেগপ্রসূত নয়, বরং এক গভীর উপলব্ধির ফল। কিন্তু একজন পিতা হিসেবে সন্তানের প্রাণের বিনিময়ে কোনো আদর্শকে সমর্থন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাই তিনি নিশ্চুপ ছিলেন, চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরে বসেছিলেন, যেন এক অদৃশ্য ঝড়ের মুখে নিজেকে কোনোমতে ধরে রেখেছেন। 

৫ই আগস্ট ভোরবেলা, নূর অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। তার এক বন্ধু তাকে দেখে ফেলে। বন্ধুর হাতে হাত রেখে সে কেবল বলেছিল, “আন্দোলনে যাচ্ছি। আব্বাকে কিছু বলিস না।” তার কথায় ছিল এক আশ্চর্য শান্তি, যেন সে জানত—এই যাত্রা তার জীবনের শেষ অধ্যায়ের সূচনা। 

বিকেলে, কক্সবাজার ঈদগাহ থানার সামনে যখন শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করছিল, হঠাৎ করেই পুলিশি হামলা শুরু হয়। আকস্মিকভাবে একটি বুলেট এসে বিদ্ধ করে নূরের পিঠ, যা তার বুক ভেদ করে বেরিয়ে যায়। মুহূর্তেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চারদিকে হইচই, চিৎকার, মানুষের দৌড়াদৌড়ি, গাড়ির হর্ন—সব মিলিয়ে এক বিভীষিকাময় দৃশ্যের অবতারণা হয়। রাজপথে লুটিয়ে থাকা রক্তাক্ত নূরের নিথর মুখ দেখে কেউ বুঝতে পারেনি, সে কী ভাবছিলো। তাকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাচ্ছিলো, যেনো শেষবারের মতো পৃথিবীর এই অবিচারকেও ভালোবাসা দিয়ে বিদায় জানাচ্ছিলো। ৬ই আগস্ট দুপুর। সেই ছোট্ট ছেলেটির নিঃশ্বাস চিরতরে থেমে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক ঘোষণা করেন—নূর মোস্তফা আর নেই। 

নূরের বাবা, শফিউল আলম, ১৯৯২ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। কক্সবাজারে এসে তিনি একটি ছোট্ট ঘর নির্মাণ করে পরিবার গড়ে তোলেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানো ছিল তার অন্যতম স্বপ্ন। নূর ছিল তার সেই স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। সেই ছেলে আজ এই দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করলো। 

কিন্তু রাষ্ট্র তাকে চিনতে পারল না। যখন শহীদ তালিকা প্রস্তুত হলো—সেখানে নূরের নাম ছিলো না। কারণ তার বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল না। তাই কাগজে-কলমে নূর বাংলাদেশি নয়। অথচ তার জন্মসনদ, স্কুলের সনদ, স্থানীয় পরিচয়—সবই ছিল। ছিল না কেবল একটি কাগজ, আর সেই অভাবই মুছে দিল তার আত্মত্যাগের স্বীকৃতি।

শফিউল আলম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমি টাকার জন্য কাঁদি না। আমি শুধু চাই, আমার ছেলের নামটা শহীদের তালিকায় থাকুক। সে তো এই দেশের জন্য প্রাণ দিলো। তার বই, তার জামা, তার সনদ—সবই এই দেশেই। তাও সে ‘অপর’ হয়ে রইল?” 

একজন মানুষের রক্ত, জীবন, আত্মত্যাগ যদি শুধুমাত্র একটি কাগজের অভাবে অস্বীকার করা হয়—তবে সেই রাষ্ট্রের বিবেক কবে জাগবে? কবে এই মাটির মানুষগুলো কেবল কাগজপত্র নয়, বরং ভালোবাসা, ত্যাগ আর ইতিহাসের আলোকে বিচার পাবে? 

শহীদ নূর মোস্তফা আজ শারীরিকভাবে অনুপস্থিত। সে মাটির গভীরে শায়িত, কিন্তু তার নাম বাতাসে ভাসমান। প্রতিটি প্রতিবাদী স্লোগানে, প্রতিটি ব্যানারের ছায়ায়, প্রতিটি চোখের অশ্রুতে সে ফিরে আসে। 

শহীদ নূর মোস্তফা কোনো পরদেশি ছিল না। সে কোনো অনাহূত আগন্তুক ছিল না। সে ছিল এই মাটির সন্তান। সে ছিল, সে আছে, সে থাকবে—বাংলাদেশের এক অস্বীকৃত শহীদ। অমর হোক নূর মোস্তফা, অপর নয়। 


তথ্যসূত্র: 

জুলাই রেকর্ডস।

 (সম্পাদক, দ্য কমন রান) 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ