১.
ভোর হলে কি জেগে উঠবে মিহি রৌদ্রছায়া?
গত সন্ধ্যায় উঠোনের দড়িতে শুকোতে দেওয়া
নাকি ঝরে পড়বে কোনো স্মৃতিবাহী পাতা?
নাকি শব্দহীন, বিষ্ময়ে, তাকিয়ে থাকবে
নিঃসঙ্গতার হাস্যত্মক তাচ্ছিল্য?
দূরে, আরো দূরে—টিনের চালে ফোঁটা ফোঁটা
নিরুত্তাপ আক্ষেপ, নামছে লাল লিপস্টিক মাখা
দিকচক্রবালের পথ ধরে; বিপর্যয় বুঝি এমন—
যেন আমার ভেতরে আজ সারাদিন বকুল-ঝরার
মতো নিস্তব্ধ কিছু শব্দ খসে পড়ে—যেন কেউ নেই
দাঁড়িয়ে চৌকাঠে—কেউ রেখে
যায়নি বালিশে উষ্ণ নিঃশ্বাস, সমুদ্র গীত।
দেখো—থরথর করে কাঁপছে অরণ্য হৃদয়,
সময়ের গহ্বরে ভ্রমণরত সঞ্চিত বেদনা।
লালকুঠির সম্মুখে, বেদনাজনিত সবুজ পথ!
হাঁসেদের সফেদ পালক; যার অবয়বে জড়িয়ে
আছে তোমার চলে যাওয়ার বিনীত আয়ুকাল।
দুঃস্বপ্ন এত মায়াময়
যেন
অপেক্ষারত পাঁজর।
যদি ফিরে আসো
একফোঁটা অপরাহ্নে…
আততায়ী প্রেমের শূন্য মোকামে
যদি বুনে যাও অনুচ্চারিত পরিত্রাণ।
৮ এপ্রিল ২০২৫
~
২.
টিটি কলোনির পূব হাওয়াতে দুএকটা
রিক্সা ঘণ্টি বাজালে এখন মনে পড়ে যায়
ফুঁ-দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া আদুরে দিনরাত্রির
আলাপচারিতা। শীতকালীন ছুটি যে গ্যালো—
এরপর থেকে মদের গ্লাসে আর দ্যাখা হলো না
প্যারিস নর্তকীর চোখের আর্শি। আমি এখন
কালর্ত্তীন কীট। আমাকে ঘিরে আকাশতলে,
আধোলীন সফেদ শাড়ি বিছিয়ে শুয়ে আছে
একটি মৃত পায়রা। আমার ক্লান্ত ছায়ায় হাত
বুলিয়ে রাজহংসী উড়ে যায় অমর্ত্য প্রেমিকার
নতুন সংসারে। অপস্রিয়মাণ সমস্ত সুখ নিয়ে
আমি এখন কোথায় যাবো অবলীলায়?
তরঙ্গহীন নিঃশ্বাসে, স্যাঁতস্যাঁতে অনর্থ জীবন
কার নরম আঙ্গুলে দিব গুজিয়ে? জানি,
হাঁসফাঁস লাগে— গুমোট অবসন্নতা নিয়ে
নিরুৎসাহিত হয়ে থাকি নিদ্রার নিকট; শরীর
জুড়ে আত্মহননের আতিথেয়তা এগিয়ে দেয়
চব্বিশটা পাখাহীন প্রজাপতির ঢং, তবুও
হৃদয়ের নিকটবর্তী সান্ত্বনার দৃষ্টান্ত রাখছি না
কোথাও! হ্যারিকেনের অর্ধনমিত আলো নিয়ে
যাচ্ছি সমুদ্র আশ্রয়ে; আমাকে কি নেবে উপচে
পড়া শামুকের ভাঙ্গা ক্লেশ? গ্রহদ্বয়ের শানিত
চোরাবালি, নাজুক নাজুক ঢেউয়ের শ্লোক!
৮ এপ্রিল ২০২৫
~
৩.
এক রহস্যঘেরা সংযমে তুমি লোপ পেলে—না জানিয়ে, শব্দহীন,
কোনো প্রাচীন অলিন্দে ঢুকে গেলে তুমি;
যেখানে তাম্রপাতায় খোদাই করা হত অন্তর্গত প্রস্থান।
রাত তখন সুস্থির নয়, শোকস্তব্ধ জানালায় পুঞ্জীভূত
হয় নির্লিপ্ত জলীয় বাস্প, আর তক্তপোশে জেগে থাকে
বিলুপ্ত এক রক্তাভ ঈশারা।
তোমাকে বলা যেত—তবু ভাষা কুয়াশার নিচে স্তব্ধ হয়ে
পড়ে, চোখ রাখলেই দগ্ধ হয় প্রেক্ষাপট। আমার ঘর
তখন জরার্ত নগরীর পুনরাবৃত্তি, আর ফার্মাসিস্টের
ভুলে পড়ে থাকে এক্সপায়ারড ঘুমের ট্যাবলেট।
তুমিও হয়ত এমন এক নৈঃসঙ্গ্যের ফসিল— দেখতে
পেলেই আমি চাই আয়না ভেঙে ফেলতে—প্রতিফলনের বদলে জন্ম নেয়এক টিকটিকির দৃষ্টি আর কসাইয়ের দাগ।
পালিয়ে যেতে চাই— উলম্ব মোড়ের রঙচটা দেয়ালে,
যেখানে চকখড়িতে আঁকা থাকে শোকবিহ্বল দিগন্ত।
আজ স্নান আটকে আছে—কলের মুখে পাথর, আর
মাথার ওপর লাইট যেন ছাঁটা-স্মৃতি ঝরায়। কুসংস্কারের
ফুল ফুটে ওঠে, অন্ধ গর্ভে জন্ম নেয় নীল মৃত্তিকা।
তুমি গলে যাও এক আশ্চর্য নিঃসন্দেহে—তবু সিঁথির
গন্ধে এখনও টিকে আছে কাঁচা মেঘের উপপাদ্য,
আমি পড়ে থাকি—অর্থের বিপরীতে, ব্যাখ্যার নিচে।
১৭ এপ্রিল ২০২৫
~
৪.
তুমি আমাকে শোকের ভাষা শেখাও— আর্তনাদ
ঝরে পড়ুক মৃত জ্যোৎস্নার মতো, ভেঙে যাওয়া
করোটির ভেতর থেমে থাকুক অনুভববর্জিত
জ্বরের উন্মাদনা।
জানি, তুমি বেছে নেবে প্রসাধন-মুখর উৎসব,
তবুও আমি চাই—কেবল এক বিন্দু লবণাক্ত অশ্রু,
যা নুয়ে পড়া গলিত ইস্পাতের মতো ঢুকে যাবে শিরায়,
ভেঙে ফেলবে যকৃত, পাঁজর আর নিষ্ক্রিয় আকুলতা।
এড়িয়ে যেও না,এ মুখোশহীন প্রার্থনায়—
আমি তো সুখ চেয়েছি এমনটা না।
আমাকে দাও নীলাভ বেদনা, তপ্ত ক্লেশের হামাগুড়ি
আর নিষিদ্ধ রাতের আত্মহনের কল্পিত ঘুম
আমিও তো হাঁপিয়ে উঠা এক কালো মানচিত্র—
নামহীন রাষ্ট্র যেখানে প্রেমের অপরাধে জারি হয় মৃত্যুদণ্ড,
আর প্রেম অক্ষরের বদলে রক্তপাত ঘটে প্রতিটি বাক্যে।
তুমি যদি যেতে চাও, আড়াল করো কেবল,
নির্বিকার নয়নে সরে যাও—যেন থিয়েটারের পর্দা,
রঙহীন হয়ে পড়ে হঠাৎ।
ক্ষমাহীন আঙুলের ছুরিতে চিরে যাক যোনি-মুদ্রিত যন্ত্রণা,
আর তবু তুমি রেখো—এক চিলতে সম্ভ্রম,
আমার দগ্ধ আত্মাহুতির পাশে।
১৭ এপ্রিল ২০২৫
~
৫.
রাত্রির গায়ে জেগে ওঠে বেদনার পরবাসী হাহুতাশ —
আলোর পিঁপড়ে ঘিরে ধরে যাবতীয় ভ্রম,
উত্তাপহীন জ্বলন থেকে ছড়িয়ে পড়ে ধূসর মেলোডি,
যাত্রীছাউনির ভিন্নভাষী প্রস্থান, কতটুকু
রেখে যায় লাঞ্চিত অনুশোচনায়?
ঘুমপাথরের ঘ্রাণে ভিজে থাকে আঙুল—
কোনো কাচের মানুষ কি রেখে গিয়েছিল
করতলের বিপর্যয়ে গলতে থাকা প্রতিশ্রুতি?
ভাষা ভেঙে যায় জিভে, তবুও বাতাসে গুঞ্জন:
“ভালোবাসা এখন আড়ালভরা এক প্রেতবর্ণ কার্নিভাল।”
আমরা দাঁড়িয়ে থাকি উজ্জ্বলতম নীলাভ দৃষ্টান্তে...
একদিন মৃত্যু এলে চেনা মানুষেরা হবে কেবল
বালিঝড়ে উড়ে যাওয়া দেবদারু;
তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে যাবে
উদাসপোকাদের গ্রন্থি—
একফোঁটা উষ্ণতা, নির্গত ক্লান্তি—যা চুরি হয়েছিল
শীতঘুমের রাতে।
তোমরা কি জানো, ডানাহীন পাখিরাও কখনো কখনো
আকাশে চিহ্ন রেখে যায়, গুমোট শুশ্রূষায়...
১৮ এপ্রিল ২০২৫
~
৬.
একটা মৃত অশ্বথ গাছ আমার মাথার ভেতর
পড়ে আছে, অব্যক্ত নীরবতায় প্রতিদিন
তপস্যাপূর্ণ দুঃখরা আরাধনা করে সন্ধ্যার
রক্তিম শীতলতাকে; দূরের— মফস্বলি তৃষ্ণায়
জ্বলে উঠে চাঁদের মৃদু শিখা, আঙুলের ক্ষীণ তেজে
আজও ফুটে ওঠে আহত পাখির মলিন পালক,
আর হৃদয়ের বৃক্ষতলে কেউ নিজের পায়ের চিহ্ন
এঁকে যায় ভাঙা অতিথিত্ব যাপনে; বিপন্ন প্রার্থনাগারে
বেদনা কেন আস্বাদিত হয় বন্ধু? ক্লান্তির
নাভিমূলে কেন কেঁপে ওঠে
ফসিলকৃত
দীর্ঘশ্বাস....
ইদানীং
সবচে প্রান্তিক নক্ষত্র আমার কানে গুজে
দিয়ে যায় বিষণ্ণতার অনুবাদ;
হাইওয়ের পাশে স্থির হয়ে থাকে
অর্ধেক মদের বোতলের ক্লান্তি;
আমি এখন ঘরে বসে, মানিব্যাগে কিছু ঋণাত্মক
ফুল, আলমারির ফাঁকে জমে আছে জ্বরগ্রস্ত
হাইবারনেশনের ময়লা চাদর, মৌন ফ্লুরোসেন্ট,
হ্যারিকেনে নিভু নিভু নস্টালজিয়া, নেহাৎ
অভাববোধে বিদ্রুপ করছে শুশ্রূষাহীন অনুশোচনা;
সবিনয়ে জানালার বাইরে হেঁটে যাচ্ছে কয়েকটি
অনাহূত পাইনগাছ...
বন্ধু, তুমি কেন যোজন যোজন দূরে—
শহরের পেটিকোটে চন্দ্রবদনী হয়ে বসে আছো—বলো?
২১ এপ্রিল ২০২৫
~
৭.
অরণ্যময় রাতে নিঃশব্দে আমি আমার অন্তঃপুরে
শুয়ে থাকব, বর্ষার প্রতি বিপন্ন জলফোঁটা আমার
শরীরে ছেদ করে রেখে যাবে শেষ আলো নিভানোর দুঃখবোধ।
অস্তিত্বের প্রলেপে ঢাকা থাকবে ধর্মপাঠ,
অলীক চিত্রাবলী, অনুশোচনা অনুনয়। বিছানার
ধূলিকণা, ভগ্নরাগ, মশারীর ভেতর ঝুলে থাকা নির্জন কথোপকথন—
এইসবের দায় আমি কুড়িয়ে নেব
গামলায় ঘুরপাক খাওয়া মাছেদের হাহাকার হতে।
তুমি তখনও পরেমশ্বর ছিলে না, যখন আমি
ছিলাম একটা অব্যক্ত চিহ্ন। যে নিজেই হারিয়েছে
তাঁর শৈশবের প্রিয় লাল ঘোড়া, মার্বেল হাতে বেড়ে
উঠলো যার অবাধ আহ্লাদী জীবন। তোমার অলিন্দে,
আমি আঙুল রাখি না, রেখে দিই নিঃশব্দ নুড়িপাথর—
তুমি তো এখন এক ধরনের নিঃশেষিত প্রত্নতত্ত্ব—
বালু সরালেই পায় তোমার ঠোঁটের ছাপ, প্রিয়
মূর্ছনার সাথে সঙ্গম; আর আমার জিভে তখনও
লেগে আছে সেই ধ্বংসের নোনা কীর্তন।
বলো, কতোটা উঁচুতে ঝুলাও তোমার স্মৃতি?
নির্মিতি থামাও!
ছাড়ো! মানবীয়তা শেষাবধি কূটচাল।
তবুও, এই মুহূর্ত? এই জেগে থাকা ঘোর?
এই ব্রহ্মান্ড-শূন্যতায় ভাসা লালিত দুরদর্শিতা?
আরণ্যক স্তব্ধতায়, নিসঃঙ্গতার নামে ধ্যানরত পাথর!!
সবই কি কল্পঘোরের ছায়ানিয়ন্ত্রিত অতিকথা?
0 মন্তব্যসমূহ